Sunday, December 10, 2023
Homeফিচারগুঁড়িয়ে দেওয়া হলো তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিচিহ্ন

গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিচিহ্ন

মানুষের জন্য ডেস্ক: ময়মনসিংহ নগরীতে আলোচিত-সমালোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছিলেন তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। নগরীর আমলাপাড়ার টি এন রায় রোডে ‘অবকাশ’ নামের বাড়িটি ভেঙে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়িটি ভেঙে ওই স্থানে টাঙানো হয়েছে ডেভেলপার কোম্পানির বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ড। ইতোমধ্যে প্রায় পুরো বাড়িটিই ভাঙার কাজ শেষ করেছেন শ্রমিকরা। তারা জানান, নয়ন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি প্রায় ৩ লাখ টাকায় ওই বাড়ির পুরোনো ইট-কাঠ ও রড কিনে নিয়েছেন। তার অধীনেই মাসখানেক ধরে শ্রমিকরা বাড়ি ভাঙার কাজ করছেন।

তাসলিমা নাসরিনের ভাতিজা সাফায়েত কবীর জানান, বাড়িটি ছিল তার দাদা প্রয়াত ডা. রজব আলীর। তিনি মারা যাওয়ার পর সম্প্রতি এই বাড়ির জমি তার উত্তরাধিকারের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। এর মধ্যে সামনের অংশে তার বাবা ও চাচার জায়গা। আর পেছনে রয়েছে ফুফুদের জায়গা।

সাফায়েত আরও জানান, নিয়ম মেনেই অংশ ভাগ করে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি তাদের পারিবারিক বিষয় এবং এতে আইনি কোনো সমস্যা নেই।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের কবি শামীম আশরাফ ওই বাড়ি ভাঙার একটি ভিডিও পোস্ট করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন : ‘তসলিমা নাসরিনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে যেখানে, সেই নান্দনিক বাড়িটা ভেঙে উঁচু হয়ে উঠছে। এভাবেই শহরের কত কত নান্দনিক বাড়ি স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। তাতে নন্দন থাকছে কতটুকু! বাড়ছে শুধুই খোপ। যেভাবে পাখি থাকে বন্দি।

পোস্টটি নজরে আসে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। ভিডিওটি দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেন তিনি। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে তিনি লেখেন : ‘কেউ কেউ ফেসবুকে ‘অবকাশ’ ভাঙার ছবি পোস্ট করছে, দুঃখ করছে, স্মৃতিচারণ করছে। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সেই অবকাশ। ময়মনসিংহ শহরের টি এন রায় রোডে আমার বাবার কেনা সুন্দর বাড়িটি অবকাশ। এই অবকাশ ভেঙে গুঁড়ো করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু এটুকু জানি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব লোভী, স্বার্থপর, ধুরন্ধর ও কট্টর মৌলবাদী। সকলেরই আমি চক্ষুশূল। এককালে শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রগতিশীলতার একটি কেন্দ্র ছিল যে বাড়িটি, আজ সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত।

তিনি আরও লেখেন, ‘ধন-দৌলতের কাঙালদের কাছে প্রগতিশীলতা, উদারতা, সহমর্মিতা, স্মৃতি ও সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই। শুনেছি বাড়িটিতে আমার মায়ের হাতের লাগানো সব ফল-ফুল গাছ শেকড়সহ উপড়ে ফেলে একটি আধুনিক বহুতল বিল্ডিং বানানো হচ্ছে। আমার কর্মঠ বাবার অকর্মণ্য উত্তরসূরিরা সেই বিল্ডিং-এ পায়ের ওপর পা তুলে বংশ পরম্পরায় খাবে।

তিনি আরও লেখেন, ‘ও বাড়ির এখন আমি কেউ নই। আমি তো ৩০ বছর ব্রাত্যই। ইট-পাথরে, চুন-সুরকিতে, কাঠে কংক্রিটে স্মৃতি থাকে না, স্মৃতি থাকে মনে। অবকাশ রইলো আমার মনে। যে বাড়িটিতে বসে আমি প্রথম কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতা-পত্রিকায় ছাপিয়েছি, প্রথম কবিতার বই লিখেছি, নির্বাচিত কলাম লিখেছি, যে বাড়িটির মাঠে প্রথম গোল্লাছুট খেলেছি, যে বাড়িটির ছাদে প্রথম পুতুল খেলেছি, যে বাড়িটির ভেতর প্রথম রবীন্দ্রনাথ আওড়েছি, উঠোনজুড়ে নেচে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ করেছি, যে বাড়িটিতে দাদা বেহালা বাজাতো, ছোটদা গিটার বাজাতো, বোন গান গাইতো, মা আবৃত্তি করতো, বাবা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো, যে বাড়িটিতে বসে প্রথম প্রেমের চিঠি লিখেছি, যে বাড়িটিতে আমি একই সঙ্গে সংবেদনশীল এবং সচেতন মানুষ হয়ে উঠেছি, সে বাড়িটি রইলো আমার মনে। কোনো হাতুড়ি-শাবল-কুড়োলের শক্তি নেই সে বাড়িটি ভাঙে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments