রাজু আহমেদ: দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাচীন স্থাপণা হলেও সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা,স্থানীয় ভূমিদস্যুদের দখল বাণিজ্য,মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের অবাধ বিচরণে প্রকৃত রূপ জৌলুস হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে রাজধানী ঢাকার প্রবেশদ্বার গাবতলী ব্রীজ সংলগ্ন সাভার উপজেলাধীন আমিন বাজারের ঐতিতিহাসিক দেওয়ান বাড়ি কমপ্লেক্স ও মসজিদটি।
সুত্র মতে, আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অর্থাৎ ১৮৬০-৬৬ খ্রিস্টাব্দে ১.০৬ একর জমিতে এই মসজিদ কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করেছিলেন তদানিন্তন কলকাতা থেকে আগত আলহাজ্ব জোনাব আলী নামে তৎকালীন দুই বাংলার বিশিষ্ট ও ধনাঢ্য এক কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী।
জনশ্রুতি রয়েছে, সে-সময় চামড়া সংরক্ষণ, মজুদ ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে দুই বাংলায় তার ৪০-৪২ গুদামঘরের মধ্যে একটি এই অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার সুবাদে ঢাকা জেলার সাভার উপজেলাধীন আমিনবাজারের তৎকালীন ‘ধোবাইর’ বর্তমান ‘বেগুনবাড়ি’ মৌজার দেওয়ান বাড়ি গ্রামে তিনি বসতি গড়ে তুলেছিলেন।
সেসময়ই স্থানীয় মুসলিম ধর্মীয় উপাস্যদের জন্যে বিশেষ ঐতিহ্যমণ্ডিত কারুকার্য খচিত ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান বাড়ি সুরম্য মসজিদ ও কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মসজিদটির ভেতরের সুশীতল ছায়াতলে শতাধিক ধর্মপ্রাণ মুসল্লীগণ একসঙ্গে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে পারতেন।
এই স্থাপনায় সংশ্লিষ্ট বিশেষ ঐতিহ্যবাহী পুকুরটিকে ঘিরে রয়েছে চারটি শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটে বসার আসন, আবাসস্থলের দখিনে ছিলো খোলা মাঠ ।
বিশেষ নির্মাণশৈলীতে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি সংলগ্ন দেওয়ান বাড়ি কমপ্লেক্সের প্রাচীন সেই স্থাপণাগুলো কালের স্বাক্ষী হিসেবে আজও দাড়িয়ে আছে।
বিশেষ ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দেওয়ানবাড়ি মসজিদটি রাষ্ট্রীয় সরকারি প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) আযান প্রচারকালে সবসময়ই প্রদর্শিত হয়। ফলে প্রাচীন স্থাপণা হিসেবে ভবন সংশ্লিষ্ট মসজিদটিকে ঘিরে উচ্চমানের নির্মাণশৈলীতে চোখধাঁধানো অন্দরসজ্জা,বিশেষ কারুকার্য ও যথাযথ সৌকর্য-সৌন্দর্য গর্বভরে উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের বহু দর্শনার্থীরা আজও এখানে আগমণ করেন।
ইতোমধ্যে দেশের প্রাচীণ ঐতিহাসিক ইমারত হিসেবে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান বাড়ি মসজিদ ও কমপ্লেক্সটির অপরিসীম গুরুত্ব সরকারের দৃষ্টিগোচর হলে গত ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে সেটিকে সংরক্ষণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
এরপর,স্থাপনাটি ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ উন্নয়ন সংরক্ষণ ও অপসারণ বিধির ২০০৮ এর উপবিধি ৬১ অনুযায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্পোরেশনের (রাজউক) মহাপরিকল্পনার আওতায় হেরিটেজ আখ্যা দিয়ে গেজেটভুক্ত করা হয়। এমনকি পরবর্তী ২০২০ সালে নতুন করে প্রকাশিত হেরিটেজ তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত হয় ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান বড়ি মসজিদ কমপ্লেক্সটি। ২০০৯ ও ২০২০ সালে গেজেট তালিকায় ক্রমিক নম্বর যথাক্রমে ৪১ ও ৪০।
এলাকাবাসির দাবি,সরকারি উদ্যোগে স্থাপনাটি রাজউক কর্তৃক গেজেটেট তালিকাভুক্ত হওয়ায় স্থানীয়রাও খুব আনন্দিত হয়ে স্থাপনাটির নির্মাণ শৈলী ও সৌন্দর্যে গর্ব ভরে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গেজেটভুক্ত হওয়ার ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রাচীন এই স্থাপণাটিকে কোন প্রকার পুনঃসংস্কার কিংবা সংরক্ষণের অগ্রগতি না দেখে হতাশ তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ,প্রাচীন স্থাপণাটিকে ঘিরে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালী মহল দখল বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। ক্ষমতা ও বাহুবল প্রয়োগ করে অবৈধভাবে দেওয়ান বাড়ি কমপ্লেক্সের পুকুরের সিংহভাগ ভরাটসহ কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ জমি দখল করে অস্থায়ী/স্থায়ী স্থাপণা নির্মাণ করে নিজেদের বাড়ঘরের মতো করে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন মাদকের সহজলভ্যতা কেনাবেচার সুযোগে সাভার উপজেলা তথা রাজধানীর অদূরবর্তী উল্লেখযোগ্য মাদকের হাটে পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপণাটি। দিনের শুরু থেকেই আনাগোনা শুরু হলেও বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে এ এলাকাটি মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের অবাধ বিচরণে অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।
এবিষয়ে স্থানীয় আমিনুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দা আক্ষেপ করে বলেন,দেশের অন্যতম একটি প্রাচীন স্থাপণা হলেও এর সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় প্রকৃত রূপ জৌলুস হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানবাড়ি মসজিদ কমপ্লেক্সটি। স্থাপনাটির ভূমি অবৈধ দখল রুখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ দ্রুত অন্ততপক্ষে কর্তৃপক্ষের তালিকাভুক্তির তথ্য সম্বলিচিত একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা।
তিনি আরো বলেন,অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে স্থাপনাটি সংরক্ষণ করলে আপাতত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা সম্ভব অন্যথায় অচিরেই স্থাপনাটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করে এলাকাবাসি রাজধানী উন্নয়ন কর্পোরেশন (রাজউক) ও সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি স্থাপনার কোনরকম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যাবে না এবং ৭ দিনের মধ্যে আংশিক দখল হওয়া পুকুরটি পুন:খননের কথা উল্লেখ করে সম্পত্তির কোনোরকম বেচাকেনা না করার জন্য রাজউকের সংশ্লিষ্ট অঞ্চল-৩ এর অথোরাইজড অফিসার স্বাক্ষরিত একটি পত্র সংশ্লিষ্ট উত্তরাধিকারীদের বরাবর প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজউকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান না থাকায় ঐতিহ্য হারানোসহ অস্তিত্ব সংকটের হুমকির মুখে রয়েছে কমপ্লেক্সটি।
এদিকে মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষায় এলাকাবাসী স্ব-প্রণোদিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও উপজেলা ইউএনও বরাবর একাধিক আবেদন দিয়েও কোনরূপ আশানুরূপ কর্তৃপক্ষের সাড়া না পাওয়ায় হতাশ তারা।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর সুফি মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, খুব দ্রুত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। না হলে এসব স্থাপনার সৌন্দর্য ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে যাবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন,নোটিশ পাওয়ার পরেও যারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধভাবে দেওয়ান বাড়ি মসজিদ ও কমপ্লেক্সের পুকুর ভরাটসহ জমি দখল করে স্থাপণা নির্মাণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে সেটি সময় সাপেক্ষ বিষয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এসব স্থাপনা অধিগ্রহণ করে ভূমি মালিকদের বিনিময় স্বরূপ ফ্ল্যাট নাকি নগদ অর্থ প্রদান করব সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে ইতোমধ্যে আমরা চারটি স্থাপনার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি বাকিগুলোর কাজ দ্রুত শুরু করব।
এফএস